Food & Health: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর প্রতি ১০ জন মানুষের মধ্যে একজন অনিরাপদ খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই সমস্যাটি বিশেষ করে বয়স্ক মানুষ, গর্ভবতী নারী, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরা, এবং অপেক্ষাকৃত কম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। তাই খাদ্য সুরক্ষা ও সঠিক খাবার গ্রহণের বিষয়ে আমাদের সচেতন থাকা খুবই জরুরি!
যদি খাবার নিরাপদ না হয়, তাহলে তা শরীরের সুস্থতার জন্য সত্যিই হুমকিস্বরূপ হয়ে ওঠে। কারণ, খাবারে সামান্য গড়মিল হলেই পেটের পীড়াসহ নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই খাবার নির্বাচন এবং প্রস্তুতির ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা খুবই জরুরি। নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর খাবার আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য।
বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে খাদ্যের কারণে নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়। সাধারণ মানুষ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা চলতে থাকে।
তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, পরিবার কিছু সহজ উপায়ে খাবার সঠিকভাবে সংরক্ষণ করে খাদ্যজনিত রোগবালাই থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে। এর জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মেনে চলা উচিত, যাতে আমরা সুস্থ থাকতে পারি।
জেনে নিন বিস্তারিত!
নিরাপদ খাবারের প্রথম ধাপ ‘আমাদের ঘর’
বিশেষজ্ঞদের মতে, নিরাপদ খাবার নিশ্চিত করার প্রক্রিয়া শুরু হওয়া উচিত আমাদের নিজ ঘর থেকেই।
কীভাবে রান্না করা বা কাঁচা খাবার সংরক্ষণ করতে হবে, খাবারের বিষক্রিয়া এড়াতে কী করণীয়, কিংবা একই খাবার বারবার গরম করলে এর গুণমান নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে কি না—এ ধরনের বিষয়ে শুরু থেকেই সচেতন থাকলে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ এড়ানো সম্ভব।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খাবার নিরাপদ রাখতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, কাঁচা ও রান্না করা খাবার আলাদা রাখা, খাবার ভালোভাবে রান্না করা, খাবার সঠিক তাপমাত্রায় রাখা, এবং রান্নার সময় নিরাপদ পানি ও কাঁচামাল ব্যবহার করা। এগুলো মেনে চললেই আপনি আপনার পরিবারকে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে পারবেন।
রান্না করার সময় যেভাবে সতর্কতা মানতে হবে
রান্নার সময় নিজের এবং খাদ্যদ্রব্যের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তবে এর পাশাপাশি কাঁচা ও রান্না করা খাবারের মধ্যে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করাও জরুরি।
উদাহরণস্বরূপ, কাঁচা মাংস, সি ফুড, এমনকি ডিমের মতো খাবার থেকে রেডি-টু-ইট (যা এখনই খাওয়া যাবে) খাবারে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ এড়াতে কাঁচা ও রান্না করা খাবার আলাদা রাখা এবং সংরক্ষণের সময় সতর্ক থাকা প্রয়োজন, যাতে খাবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।
তাই, যে বোর্ডে কাঁচা মাংস কাটা হয়, সেটি ভালোভাবে না ধুয়ে তাতে ফলমূল বা শাকসবজি কাটার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। এটি খাদ্যের নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়া, মাংস, পোল্ট্রি, ডিম এবং সি ফুড রান্নার সময় খেয়াল রাখতে হবে যে তা অন্তত ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রান্না করা হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, খাবার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তাপমাত্রা যদি ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে এবং ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে থাকে, তবে খাবারে ব্যাকটেরিয়া জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। এই নিয়মগুলো মেনে চললে খাবার আরও নিরাপদ থাকবে এবং খাদ্যজনিত রোগ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব।
খাবার বারবার গরম করলে কী হয়
তাপমাত্রা নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকলেও, অনেক সাধারণ মানুষ তা জানেন না। তাই অনেকেই ফ্রিজে রাখা খাবার বারবার গরম করে খান, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
ল্যাবএইড হাসপাতালের পুষ্টিবিদ সামিয়া তাসনিম এ বিষয়ে বলেন, “খাবার বারবার গরম করলে প্রথমত এর পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, এতে খাবারে ব্যাক্টেরিয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে, যা স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। এই কারণেই খাবার সংরক্ষণ এবং গরম করার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা জরুরি। এটি পেটের জন্য বেশ ক্ষতিকর হতে পারে, যার ফলে ডায়রিয়া বা বদহজমের মতো সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
পুষ্টিবিদ সামিয়া তাসনিম আরও বলেন, “যদি খাবার বারবার গরম করা হয়, তাহলে খাবারের উপাদানগুলোতে রাসায়নিক পরিবর্তন হতে পারে, যার ফলে বিষাক্ত পদার্থ তৈরি হতে পারে। এটি দীর্ঘমেয়াদে ক্যানসারের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দিতে পারে।
ফ্রিজে কীভাবে Food রাখতে হবে?
ফ্রিজে কীভাবে Food রাখতে হবে?, ফ্রিজের সহজলভ্যতার কারণে আমরা প্রায়শই খাবার ফ্রিজে রেখে সংরক্ষণ করি। এটি এখন আমাদের দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
কিন্তু পুষ্টিবিদদের মতে, ফ্রিজে দীর্ঘদিন খাবার সংরক্ষণ করা উচিত নয়। কারণ, দীর্ঘ সময় ফ্রিজে রেখে দিলে খাবারের রং পরিবর্তন হয়, স্বাদে গন্ধ চলে আসে এবং পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়ে যায়, যা স্বাস্থ্যের জন্য মোটেও ভালো নয়।
বিশেষ করে পচনশীল খাবারগুলোর ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। এগুলো রান্নার দুই ঘণ্টার মধ্যে ফ্রিজে রাখতে হবে এবং সঠিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হবে। তবে এসব খাবারকেও খুব বেশিদিন ফ্রিজে রেখে দেওয়া ঠিক হবে না।
মিজ তাসনিম এ বিষয়ে বলেন, গরমের সময় খাবার সঠিকভাবে ফ্রিজে সংরক্ষণ করা অত্যন্ত জরুরি, এবং বাসি খাবার একেবারেই খাওয়া উচিত নয়। তিনি আরও সতর্ক করেন, “ফ্রিজে রাখা মানেই যে খাবার একেবারে ‘নিরাপদ’, তা কিন্তু নয়। বিশেষ করে গরমের এই সময়টায় লোডশেডিং বেশি হয়, ফলে ফ্রিজের খাবারেও ব্যাকটেরিয়া জন্ম নিতে পারে।” তাই, ফ্রিজে খাবার রাখলেও সেটি সঠিক নিয়মে সংরক্ষণ করতে হবে এবং লোডশেডিংয়ের সময় ফ্রিজের খাবারের ব্যাপারে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে।
ফ্রিজের তাপমাত্রা সঠিকভাবে বজায় রাখতে হবে এবং খাবার বাইরে দীর্ঘ সময় ফেলে রাখা উচিত নয়। আমরা বড়জোর দুই দিন ফ্রিজে খাবার রেখে তা খেতে পারি। এর পর অবশ্যই নতুন করে রান্না করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ফ্রিজ থেকে খাবার বের করেই সঙ্গে সঙ্গে খাওয়া যাবে না। ফ্রিজ থেকে বের করার পর খাবারকে কিছুক্ষণ স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রেখে তারপর গরম করতে হবে। আবার গরম করার পরও খাবার সঙ্গে সঙ্গে না খেয়ে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় আসতে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা উচিত।
খাবার থেকে বিষক্রিয়া
আমাদের অনেকেই আছেন, যারা খাবার পলিথিন বা প্লাস্টিকের মোড়কে আনতে অভ্যস্ত। তবে এটি শরীরের জন্য মোটেও ভালো নয়, বিশেষত যখন গরম খাবার তাতে নেওয়া হয়।
প্লাস্টিক বা পলিথিনে গরম খাবার বা পানি রাখলে সঙ্গে সঙ্গেই রাসায়নিক বিক্রিয়া শুরু হয়, যার ফলে বিসফেলন-এ (BPA) তৈরি হয়। এই রাসায়নিকটি শরীরে প্রবেশ করে থাইরয়েড হরমোনের কার্যকারিতায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই, গরম খাবার পরিবহণ বা সংরক্ষণের জন্য প্লাস্টিক এড়িয়ে চলাই ভালো।
বিসফেনল-এ (BPA) একটি সাধারণ রাসায়নিক পদার্থ, যা সাধারণত প্লাস্টিকের পাত্র তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি মানুষের শরীরে নানা রকম ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। এবং খাবার থেকে বিষক্রিয়া হতে পারে।
পুষ্টিবিদ মিজ তাসনিম বলেন, “বিসফেনল-এ থাইরয়েড হরমনের কার্যকারিতাকে বাধাগ্রস্ত করে। এটি মস্তিষ্কের গঠনের ওপরেও প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে, গর্ভবতী নারীদের রক্তের মাধ্যমে BPA ভ্রূণের শরীরে পৌঁছাতে পারে, যা ভ্রুণের ক্ষতি করে এবং বন্ধ্যাত্বের কারণ হতে পারে। এমনকি এর প্রভাবে শিশুও বিকলাঙ্গ হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে।
এইসব বিষয় বিবেচনায় গরম খাবার পলিথিন বা প্লাস্টিকের মোড়কে নেওয়া উচিত নয়। তবে বাজার থেকে কাঁচা খাবার কিনতে গেলে প্লাস্টিনের ব্যাগ ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু গরম খাবার বা পানীয়ের জন্য নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যকর বিকল্প খোঁজাটা জরুরি। স্বাস্থ্যবান জীবনযাপনের জন্য সচেতনতা এবং নিরাপদ খাবার নির্বাচন করতে হবে, যাতে আমরা নিজেদের এবং পরিবারের স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখতে পারি।
পরিবারে খাদ্য নিরাপত্তার সুবিধা
বাসাবাড়িতে খাবারের নিরাপত্তার বিষয়টি মেনে চলা হলে কী কী সুবিধা হতে পারে, সে সম্বন্ধে কয়েকটি বিষয় চিহ্নিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। যথা—
নিরাপদ খাবার আমাদের পরিবারের শিশুদের বেড়ে ওঠা ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদি খাবার নিরাপদ হয়, তবে তা শিশুদের স্কুলে উপস্থিতি বাড়াতে সহায়ক এবং পরিণত বয়সে কর্মক্ষেত্রে তাদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে।
এছাড়া, নিরাপদ খাবার খেলে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার খরচও কমে যায়, কারণ স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা কম হয়। নিরাপদ খাবার কর্মক্ষেত্রে উপস্থিতি এবং উপার্জনক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। সব মিলিয়ে, নিরাপদ খাবার আমাদের শরীরের দীর্ঘমেয়াদী উন্নতির জন্য অপরিহার্য। সুতরাং, নিরাপদ খাবার নির্বাচন করা শুধু আমাদের স্বাস্থ্যেই নয়, বরং আমাদের ভবিষ্যৎও সুরক্ষিত করে।
I like it