ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে ‘চোর সন্দেহে’ এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাত ৮টা পর্যন্ত পাঁচজনকে আটক করেছে পুলিশ। তোফাজ্জলদের বাড়ি বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার কাঁঠালতলি ইউনিয়নে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে যখন তোফাজ্জল হোসেনকে মারধর করা হচ্ছিল, তখন তিনি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে স্বজনদের নম্বর দেন। খবর পেয়ে তার মামাতো বোন আসমা আক্তার তানিয়া একটি ছাত্রের নম্বরে ফোন করে তাকে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করে বলেন, “ও পাগল”। তখন সেই ছাত্রটি উত্তরে বলে, “পাগল হলে এত নম্বর মনে রাখে কীভাবে?” তানিয়ার অভিযোগ, এরপরই তাকে আরও বেশি মারধর করা হয়।
তানিয়া ফোনে আকুতি জানিয়ে ছাত্রদের বোঝানোর চেষ্টা করেন, তার মামাতো ভাই মানসিকভাবে অসুস্থ। কিন্তু কেউ তার কথা শোনেনি। বরং, তারা বারবার তোফাজ্জলের মুখস্থ করা ফোন নম্বর নিয়ে প্রশ্ন করতে থাকে।
বৃহস্পতিবার দুপুরে তোফাজ্জলের মরদেহ নিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে এসেছিলেন তার স্বজনেরা। তারা জানাচ্ছেন, হলের ছাত্ররা তোফাজ্জলের কাছ থেকে নম্বর নিয়ে তাদের ফোন করে মুক্তিপণ দাবি করেছিল। আর কেন তার এত নম্বর মুখস্থ, সেটা নিয়ে সন্দেহ করেই আরও বেশি মারধর করে। মধ্যরাতে তোফাজ্জলকে যখন ঢাকা মেডিকেলে আনা হয়, তখনই তার মৃত্যু হয়েছিল। তার শরীরে ছিল নির্যাতনের অগণিত আঘাতের চিহ্ন, যা সেই ভয়াবহ রাতের কথাই বলে।
ঢাকা মেডিকেল মর্গে নিহতের লাশ ময়নাতদন্তের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান কাজী গোলাম মোকলেসুর রহমান বলেন, নিহতের সারা শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
তোফাজ্জল জীবনের কাহিনী
মর্গে এসে মামাতো বোন আসমা আক্তার তানিয়া বলেছেন, “তোফাজ্জলের পরিবার ছিল একটি সুখী পরিবার, বাবা, মা এবং দুই ভাই নিয়ে। আট বছর আগে এক সড়ক দুর্ঘটনায় তোফাজ্জলের বাবা মারা যান, আর পাঁচ বছর আগে তার মা।
মায়ের মৃত্যুর পর তোফাজ্জলের আচরণে পরিবর্তন দেখা দেয়। তখন তার বড় ভাই, পুলিশের এসআই নাসির হোসেন, তাকে দেখাশোনা করতেন এবং মানসিক রোগের চিকিৎসা করাতেন। কিন্তু গত বছর রোজার সময় সেই ভাইও ক্যান্সারে মারা যান। এরপর থেকে তোফাজ্জলকে দেখার মতো কেউ আর ছিল না। তখন থেকেই সে পথে পথে একেবারে উন্মাদ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।
তানিয়া জানিয়েছেন, তারা তোফাজ্জলকে মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তাকে ধরে কোথাও নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত, যখন তাকে পাবনার মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, সেদিন সকালে তিনি শিকল ভেঙে পালিয়ে যান।
এরপর ঢাকায় সে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতেন। তানিয়া বলেন, “৫ আগস্ট রাজু ভাস্কর্যের সামনে যখন টেলিভিশনগুলো লাইভ সম্প্রচার করছিল, তখন তোফাজ্জল বারবার ক্যামেরার সামনে আসছিল। সে সাক্ষাৎকার দিতে চাইছিল, আর তার সেই ভিডিও আমরা দেখেছি।”
তোফাজ্জলদের বাড়ি বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার কাঁঠালতলি ইউনিয়নে। বরিশাল বিএম কলেজ থেকে হিসাব বিজ্ঞানে মাস্টার্স করার পর, মানসিক সমস্যার কারণে কোনো কাজকর্ম করতে পারেননি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঘুরে বেড়াতেন। বুধবার রাতে কোনো এক সময়ে তিনি ফজলুল হক হলে চলে যান, যেখানে মোবাইল ফোন চুরির কারণে কয়েকজন ছাত্র উত্তেজিত ছিল। তাকে দেখে তারা প্রশ্ন করতে থাকে।
ফোন নম্বর মুখস্থ থাকাই কাল?
তানিয়া বললেন, “যখন তোফাজ্জল আমার আব্বার নম্বর, তার ভাবির নম্বর, চাচাত ভাইদের নম্বর দিয়েছিল, তখন তাকে আরও বেশি মারছিল। তারা বারবার বলছিল, ‘একটা পাগলের এত নম্বর মুখস্থ থাকে কীভাবে?’
‘পাগলে ক্যামনে এত নম্বর মনে রাখে’—এটা বলেই তারা আরও মারছিল,” তানিয়া আবারও বলেন।
কিন্তু সব পাগল তো এক রকম নয়। সব পাগলের আচরণ তো একই রকম নয়,”—তার কণ্ঠে ভাইয়ের জন্য একটা আবেদনের গূঢ়তা ঝরে পড়ছিল।তানিয়া তখন ফোনে ভাইকে বাঁচাতে কাকুতি মিনতি করতে থাকেন, কিন্তু কারও মন গলেনি।
“আমি তাদের বললাম, ‘আপনারা যাকে ধরছেন, সে কোনো অপরাধী নয়, সে পাগল। হয়তো খিদা লাগলে কারও খাবারের দিকে হাত বাড়াতে পারে বা টাকা চাইতে পারে, কিন্তু এর বেশি কিছু সে করে না। সে পাগলামি করে কাউকে মারধর করে না বা কারও ক্ষতি করে না।’ কিন্তু তারা কিছুই শোনেনি। এমনভাবে কোনো মানুষ আরেকজন মানুষকে মারতে পারে না। আমরা এর বিচার চাই।”
আটক ৫ শিক্ষার্থীর দুজন ছাত্রলীগের পদধারী
আটককৃতদের মধ্যে রয়েছেন হল ছাত্রলীগের সাবেক উপবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক জালাল আহমেদ, সাবেক গণযোগাযোগ ও উন্নয়ন বিষয়ক উপসম্পাদক আহসান উল্লাহ, মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের মোহাম্মদ সুমন, পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের মোত্তাকিন সাকিন, এবং ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থী আল হোসাইন সাজ্জাদ।
জালাল আহমেদ ও আহসান উল্লাহ ছাড়া অন্যান্য আটককৃত শিক্ষার্থীরা ফজলুল হক মুসলিম হল শাখা ছাত্রলীগ কমিটির কোনো পদধারী নন, তবে কয়েকজন শিক্ষার্থী নিশ্চিত করেছেন যে তারা ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মো. তালেবুর রহমান এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “ঘটনা ঘটার পর থেকে আমরা আমাদের পুলিশি কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছি। এটি তদন্তের বিষয়, তদন্তের মাধ্যমে পুরো ঘটনা বেরিয়ে আসবে। আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে বিস্তারিত তথ্য জানা যাবে। আমাদের পুলিশের ডিবি টিমও কাজ করছে।”
তিনি আরও জানান, “ঘটনায় যারা সংশ্লিষ্ট, তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। আশা করি, এই রহস্য খুব সহজেই উন্মোচন করতে পারব।” শাহবাগ থানার ওসি জানিয়েছেন, আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসা হয়েছে।